1. admin@news.bholarnews.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পূর্বাহ্ন

হাসপাতাল নয় যেনো ভুতুরে বাড়ি, জনবল সংকটে চিকিৎসা সেবা বন্ধ

  • প্রকাশ কাল বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি:

১৯৯৮ সালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণে দক্ষিণ আইচা থানার চারটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষে সৌদি সরকারের আর্থিক সহায়তায় ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও জনবল সংকটসহ নানা কারনে হাসপাতালটির পুরোপুরি স্বাস্থ্যসেবায় ফিরতে পারেনি। বর্তমানে হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় হাসপাতাল ভবন ও আবাসিক ভবনগুলো জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাহির থেকে দেখলে মনে হয় ভুতরে বাড়ি। সন্ধ্যা নামলে সেখানে বসে মাদকের আড্ডা। হাসাপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামগুলোও অকেজো অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে। দিনের বেলায় হাসপাতালে বিতরে প্রবেশ করলেও শরীর ছমছম করে উঠে। বর্তমানে আবাসিক মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসারসহ ৯জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত থাকলেও হাসপাতালটির দেখভাল না করায় দিন দিন সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। অসহায় সুবিদা বঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষে দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালটির কার্যক্রম চালু করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যায়ে হাসপাতালের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে হাসপাতালের চারতলা ভবন, চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য ২তলা বিশিষ্ট ২টি ও ১তলা বিশিষ্ট ৩টি ভবন নির্মান করা হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, ইসিজি, ডেন্টাল ইউনিট, অ্যাম্বুলেন্স, অপারেশন থিয়েটার, হাই ভোল্টেজ ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিয়ে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। হাসপাতালটির জনবলের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ হয় ১৯৯৮ সালের জুন মাসে। ২০০০ সালে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিয়ে ২০০১ সালের আগস্ট মাসে বহি:বিভাগ চালু করা হয়। আন্ত:বিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু হয় ২০০৪ সালে। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আন্ত:বিভাগ, জরুরী বিভাগ ও বহি:বিভাগ চালু ছিল। হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ থেকে দেওয়া হতো।

হাসপাতালের সূত্রে আরো জানা যায়, হাসপাতালটিতে চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ মোট ৩২ টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ১টি, মেডিকেল অফিসার ৪টি, সিনিয়র স্টাফ নার্স ৪টি, ফার্মাসিস্ট ২টি, মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ল্যাব) ২টি, প্রধান সহকারি ১টি, অফিস সহকারি ১টি, চালক ১টি, ওয়ার্ড বয় ২টি, আয়া ২টি, নিরাপত্ত প্রহরী ৩টি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৩টি, মালি ১টি, অফিস সহায়ক ২টি, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট ১টি ও কুক/মসলাবিট ২টি। হাসপাতালটি চালুর সময় সব কয়টি পদে জনবল থাকলেও পর্যায়ক্রমে তারা অনত্র চাকরি নিয়ে চলে যায়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে হাসপাতালে কর্মরত ১৬জন কর্মচারী রাজস্বখাতে নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করেন। ২০১৬ সালে সে মামলার রায় পায় ওই কর্মচারীরা। আাদলতের রায়ের পর তারা অন্য হাসপাতালে চলে যায়।

৩২টি পদের মধ্যে ২৩টি পদই শূণ্য। আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) পদে রয়েছেন ডা. হুমায়ুন কবির, অফিস সহকারী পদে রয়েছেন মো. হাবিবুল হক, কুক/মসলাবিট পদে রয়েছে আঞ্জুমান বেগম। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সংযুক্তি হিসেবে হাসপাতালটিতে কর্মরত রয়েছে একজন চিকিৎসক ও পাঁচজন কর্মচারী। এদের মধ্যে চরফ্যাশন হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. তালহা সামিউল হক, ৩০ শয্যা বিশিষ্ট খায়েরহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় মো. বশির উল্লাহ, মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় মো. নিরব হোসেন, মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়া রুজিনা আক্তার, একই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. কামাল হোসেন, নিরাপত্তা প্রহরী মো. আব্দুস সহিদ। যারা কর্মরত রয়েছে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন কতরেন না বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের।

সম্প্রতি হসপাতালটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসাপাতালটির সীমানা প্রাচীরের গ্রিল ও মূল ভবনের ভিতরে বিভিন্ন কক্ষের দরজা ভাঙ্গা এবং জানালার গ্লাস ভাঙ্গা। দোতলায় বাথরুমের বেসিন এবং কমোড ভেঙে পড়ে আছে। কক্ষগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। তিনতলার গেইট বন্ধ থাকায় ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। ছাদে মাদকের সেবনের প্রমান পাওয়া গেছে। হাসপাতালের আবাসিক ভবনগুলোও সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতাল ভবনের নিচ তলায় এবং আবাসিক ভবন গুলো মাদক ও জুয়ারীদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনগুলোর দরজা ভেঙে বাহিরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিও ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। হাসপাতালটির চারপাশের খালি জায়গাগুলো বন-জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। এ যেনো একটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিনত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. হুমায়ুন কবির হাসপাতালে কর্মরত থাকার কথা থাকলেও গত কয়েক মাসে তিনি একবারও হাসপাতালে আসেন নাই। লালমোহন উপজেলায় নিজ এলাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে সেখানেই রোগী দেখেন। এছাড়া মেডিকেল অফিসার ডা. তালহা সামিউল হককে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে হাসপাতালটিতে সংযুক্তি দেওয়া হলেও তিনি রোগী দেখেন দক্ষিণ আইচা একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বর্তমানে একমাত্র অফিস সহকারী হাবিবুল হক পুরো হাসপাতালটি দেখভাল করছেন। বাকি কর্মচারীরা হাসপাতালে কর্মরত থাকার কথা থাকলেও হাসপাতালে উপস্থিত না থেকে তারা নিজেরা বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানে সময় দিচ্ছেন।

হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসা আয়াতুন নেছা নামের এক বৃদ্ধা জানান, তার নিজের বাত-ব্যাথা এবং নাতনি জোহানার সর্দি-কাশির জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তার না পাওয়ায় চলে যাচ্ছেন।

জয়নাল নামের আরেক রোগী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্টিকের ভুগছেন। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছেন হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তার না থাকায় পল্লী চিকিৎসককের কাছে যাচ্ছেন।

দক্ষিণ আইচা বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম জানান, হাসপাতালের গেইট সব সময় খোলা থাকায় মাদকসেবী ও জুয়াখোরদের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে হাসপাতালটি। আবাসিক ভবনগুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। যেখানে ডাক্তার ও নার্স থাকার কথা। সেখানে গরু-ছাগলের বসবাস। হাসপাতালটি এখন একটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালটি চালুর দাবী জানান তিনি।

স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক হাছনাইন, মিজান মীরসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, এই এলাকার মানুষজন অসুস্থ হলে প্রায় ২৫ থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চরফ্যাশন উপজেলা শহরে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়। হাসপাতালটি চালু থাকলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। বর্তমান সরকার প্রধানউপদেষ্টার নিকট হাসপাতালটি রাজস্ব খাতে নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়ে উপকূলীয় এলাকার অবহেলিত লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালটি চালুর দাবি জানান তারা।

হাসপাতালের অফিস সহকারী মো. হাবিবুল হক জানান, চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের কারণে এ অঞ্চলের মানুষ স্বাসন্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে থাকা ডা. হুমায়ুন কবির কখনো সপ্তাহে একবার আসেন। আবার কখনো দুই তিন মাস পর আসেন। চরফ্যাশন হাসপাতাল থেকে সংযুক্তিতে দেওয়া মেডিকেল অফিসার ডা. তালহা সামিউল হক মাঝে মধ্যে বহিঃবিভাগে রোগী দেখেন। এতে ৩০-৩৫ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। আর যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এ হাসপতালের স্থানীয় নিয়োগ প্রাপ্ত তারাও গত ১০ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। হত জুন মাসে তাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী জানুয়ারী মাস থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হবে বলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুনেছেন। তবে হাসপাতালের বেহাল অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার না করার কারনে অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো চালানোর মতো লোকবল নেই। তাই সেগুলোও এখন বাদ হয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ফোন রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দেন। এর একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

ভোলার সিভিল সার্জন ডা. কেএম শফিকুজ্জামান জানান, হাসপাতালটিতে মাত্র চারজন স্টাফ রয়েছে। আর বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আরো কয়েকজন চিকিৎসক ও কর্মচারী সংযুক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা সেখানে কর্মরত রয়েছেন তাদের বেতন পেতে একটু সমস্য হচ্ছে। আশা করি সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে পেয়ে যাবেন। এছাড়াও যে সকল চিকিৎসক ও কর্মচারীদেরকে সেখানে সংযুক্তিতে দেওয়া হয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরো জানান, হাসপাতালটির চিকিৎসক ও জনবল সংকট নিরসনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে। চিঠির জবাব পেলে আশাকরি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হবে।

 

শেয়ার করুন...

এধরণে আরও নিউজ